ভারী বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে পর্যটন শহর কক্সবাজার। শহরের ৯০ শতাংশ এলাকা ডুবেছে। প্রধান সড়ক, সৈকত সড়কসহ অন্তত ৩৫টি উপসড়ক বৃষ্টির পানিতে ডুবে কয়েক শ দোকানপাটের মালামাল নষ্ট হয়েছে।
হাজারো ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে। সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হওয়ায় মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। জলাবদ্ধতার কারণে সৈকতে হোটেল মোটেল জোনের ১৮টি সড়ক ডুবে গেছে। পাঁচ শতাধিক হোটেল মোটেলের কয়েক হাজার পর্যটক আটকা পড়েছেন।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও এলাকাবাসী জানান, গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা থেকে বৃষ্টিপাত শুরু হলেও ভারী বর্ষণ শুরু হয় দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে। এরপর রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত টানা ১২ ঘণ্টার ভারী বর্ষণ পুরো শহরের আট লাখ মানুষের কর্মজীবন অনেকটাই থামিয়ে দেয়। এমন ভারী বর্ষণ গত ৫০ বছরে দেখেননি কেউ।
শহরের ব্যস্ততম পাঁচ কিলোমিটারের প্রধান সড়কও পানিতে ডুবেছে। সড়কের কলাতলী, সুগন্ধা, বাজারঘাটা, বড়বাজার, এন্ডারসন সড়ক, টেকপাড়া, বার্মিজ মার্কেট এলাকা, বৌদ্ধমন্দির সড়ক, গোলদিঘিরপাড়, তারাবনিয়াছড়া, রুমালিয়ারছড়ার কয়েক শ দোকান, অফিস-আদালত ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে বৃষ্টির পানি জমে আছে। হাজারো ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে।
বাহারছড়া এলাকা বাসিন্দা ও জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা মুফিজুর রহমান (৫৫) বলেন, এমন ভারী বর্ষণ এ জীবনে তিনি দেখেননি। বর্ষণে তাঁর বসতবাড়িসহ পুরো বাহারছড়া ডুবে গেছে।
পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের সমিতিপাড়া, কুতুবদিয়াপাড়া, ফদনারডেইল, মোস্তাইক্যাপাড়া, বন্দরপাড়া, উত্তর নুনিয়াছটার কয়েক শ ঘরবাড়ি বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে।
১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আকতার কামাল বলেন, ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকলে এই ওয়ার্ডের অন্তত ১০ হাজার ঘরবাড়ি ডুবে যাবে। এই ওয়ার্ডে অন্তত ৭০ হাজার জলবায়ু উদ্বাস্তু ও ভাসমান শ্রমজীবী মানুষের বসবাস। রান্নাবান্না বন্ধ থাকায় হাজার হাজার মানুষ খাবার ও পানীয় জলসংকটে আছেন।
পৌরসভার ৬, ৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের পাহাড়তলী, বৈদ্যঘোনা, ঘোনারপাড়া, বাদশাঘোনা, খাজা মঞ্জিল, লাইটহাউস, কলাতলী, কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল, লারপাড়াসহ কয়েকটি এলাকায় অন্তত ২৩টি উপসড়ক ডুবে আছে। পাহাড়তলী এলাকার ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম বলেন, পাহাড়ি ঢলের পানিতে পাহাড়তলীর তিনটি সড়ক ডুবে কয়েক শ ঘরবাড়ি ও পাঁচটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে পড়েছে। নারী-শিশুরা চরম দুর্ভোগ আছেন।
কক্সবাজার হোটেল মোটেল গেস্টহাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম সিকদার বলেন, ভারী বর্ষণ হলেই হোটেল মোটেল জোনে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। তখন পর্যটকের দুর্ভোগ দেখা দেয়, ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দাভাব বিরাজ করে। পাহাড় কাটার মাটি নেমে এসে নালা ভরাট হওয়ায় বৃষ্টির পানি দ্রুত সাগর-নদীতে নেমে যেতে পারে না। তাই জলাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে। গত জুলাই মাসেও কয়েক দফায় ভারী বর্ষণ হয়েছিল। তখনো শহরজুড়ে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছিল।
শহরের তারাবুনিয়াছড়ার বাসিন্দা ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আয়াছুর রহমান বলেন, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পৌরসভার মেয়রসহ অধিকাংশ কাউন্সিলর আত্মগোপনে যান। শহরের ময়লা–আবর্জনায় নালা-নর্দমা ভরে আছে। ভারী বর্ষণ ও পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢলের পানি নালা দিয়ে নেমে যেতে পারছে না বলেই শহরজুড়ে এমন জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। সড়কের যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় সাধারণ মানুষের চরম দুর্ভোগ যাচ্ছে।
সদরের ঝিলংজা, উপজেলা গেইট, বাংলাবাজার, মোক্তারকুল, ডিককুল এবং পিএমখালীর নিম্নাঞ্চল ডুবে গেছে। রামু উপজেলার দক্ষিণ মিঠাছড়ি, খুনিয়া পালং, উখিয়া উপজেলার হলদিয়া পালং , জালিয়া পালং, রত্না পালং রাজাপালং ও পালংখালী ইউনিয়নে অন্তত ৪০ গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে। হলদিয়া পালং , জালিয়া পালং, রত্না পালং রাজাপালং ও পালংখালী ইউনিয়নে অন্তত ৩০ গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে।
এসব এলাকার আমন চাষাবাদ, ফসল ও পানের বরজের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। তীব্র ঝড়ো বাতাসে কাঁচা ঘরবাড়ি নষ্ট হয়ে পড়েছে।
গ্রামীণ অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা বিধ্বস্থ হয়েছে। পুকুর ও প্রজেক্ট ডুবে মৎস্য চাষে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। এ পর্যন্ত জেলার উপকূলীয় এলাকার লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি অবস্থায়। এ পরিস্থিতিতে দূর্গত এলাকার মানুষ দৃশ্যমান কোন সাহায্য সহযোগিতা পায়নি বলে অভিযোগ উঠেছে।
এদিকে অতি বৃষ্টির কারণে পাহাড় ধসের শংকা বেড়ে গেছে। ইতোমধ্যে আজ শুক্রবার ভোররাতে কক্সবাজার সদরের দক্ষিণ ডিককুল এবং উখিয়ার হাকিমপাড়া ১৪ নং ক্যাম্পে পাহাড় ধ্বসের পৃথক ঘটনায় দুই পরিবারের ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। জেলাজুড়ে ভারী বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় নতুন করে বন্যা ও পাহাড় ধসের আশংকা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
আবহাওয়া অধিদপ্তর কক্সবাজারের সহকারী আবহাওয়াবিদ আবদুল মান্নান জানিয়েছেন, গত ২৪ ঘণ্টায় ৫০১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। যা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। পাশাপাশি বাতাসের তীব্রতা বেশি থাকবে যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে সর্বোচ্চ ৬০ কিমি পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে।
কক্সবাজারে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক বিভীষণ কান্তি দাশ বলেন, শুক্রবার সকালে ঝিলংজায় ঘটনাস্থলে গিয়ে নিহত তিন জনের পরিবারকে ৭৫ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা দিয়েছে জেলা প্রশাসন। পাহাড়ের ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থান থেকে লোকজনকে সরিয়ে আনা হচ্ছে। ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে চারটি পৃথক টিম মাঠে নেমেছে।